সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার ইচ্ছা ও সন্তানদের স্বপ্ন পূরণে প্রবল আক্ষেপে শেষ সম্বল ১বিঘা (৩৩ শতক) জমি বিক্রি করে দুই ছেলেকে একসাথে চীনে পাঠান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে। দীর্ঘদিন থেকে তিনবেলা খেয়ে না খেয়ে ভ্যান চালিয়ে সন্তানদের খরচ যোগান দিচ্ছেন ভ্যান চালক মকিম উদ্দীন।
ভ্যানচালক মকিমউদ্দীন শিক্ষিত না হলেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভে সুদূূর চীনে পাঠিয়েছেন। ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মকিমউদ্দীন।
বড় ছেলে হবিবুর রহমান চীনের জিয়াংসু ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ডিজাইন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচার অটোমেশন বিভাগ ও ছোট ছেলে আবুল হাসিম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করছেন।
ভ্যানচালক হলেও মকিমউদ্দীনেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞা যেন এখন বাস্তবতার মুখ দেখছে। নিজে কঠোর পরিশ্রমে ভ্যান চালিয়ে দুই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন সুদূর চীন দেশে। বর্তমানে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যানের আয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের ভরণপোষণ করছেন তিনি।
মকিমউদ্দীনের পরিবারে চার সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কষ্টের সংসারে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় সমাজে এক আলাদা সম্মানের জায়গা তৈরি হয়েছে মকিমউদ্দীনের।
স্থানীয়রা বলেন, বাবা কতটা কষ্টের উপার্জনে ছেলেদের পড়াশোনা করাচ্ছেন, তা বলার মতো নয়। আমাদেরও সন্তান আছে। সবাই এমন হয় না। তবে তারা আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। কষ্ট ও পরিশ্রম করে সব কাজ করা যায়, তারই দৃষ্টান্ত প্রতিবেশী মকিমউদ্দীনের দুই ছেলে। তারা দিন আনে দিন খায়। তারা অনেক কষ্ট করে তাদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক অভাবেও তারা সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ রাখেননি। বিষয়টি আসলে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো। আমরা আশা করছি, তারা দক্ষ প্রকৌশলী হয়ে এলাকা ও দেশসেবায় নিয়োজিত থাকবেন।
মকিমউদ্দীনের স্ত্রী হুসনে আরা বেগম বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে।
মেয়ে দুটোকে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছি। পৈতৃক এক বিঘা আবাদি জমি ছিল। ছেলে দুটোর জন্য তা বিক্রি করতে হয়েছে। একমাত্র ভ্যানটি আমাদের সম্বল। বাবুর বাবার বয়স হয়েছে, তবুও প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে বের হন। কোনোদিন তিনি বসে থাকেন না। আজ ছেলেরা চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করছে। প্রতি মাসে টাকা দিতে হয়। ছেলে দুটাও অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে সেখানে। আমাদের যত কষ্টই হোক, আমরা তাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করাতে চাই।’
আর বাবা মকিমউদ্দীন বলেন, ‘আমি ২৮ বছর ধরে পা দিয়ে ভ্যান চালিয়ে আসছি। পরে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান কিনেছি। চালাচ্ছি পাঁচ বছর ধরে। অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে পারিনি। তবে আমার ইচ্ছা ছিল আমার সন্তানদের পড়াশোনা করাব। আমার একমাত্র আয়ের পথ ভ্যান। যা হয় তার সবটুকু জমা করে ছেলেদের পাঠাই। আমরা স্বামী-স্ত্রী কখনো খাই, কখনো না খেয়ে থাকি। কাউকে বলা হয় না এ কষ্টের কথা। এভাবেই দিন কাটে।’
মকিমউদ্দীনের বড় ছেলে হবিবুর রহমান চীনে থাকলেও কথা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে ২০১৯ সালে ডিপ্লোমা করতে আসি। এখানে পড়াশোনা করতে আসার আগে বাবা তার শেষ সম্বল ৩৩ শতাংশ জমি বিক্রি করেছেন। আমার বাবা মাঝে মাঝেই ফোনে বলে, বাবা, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তোমাদের মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। আমি আমার বাবাকে সান্ত্বনা দিই, বাবা, চিন্তা করবেন না। আপনার স্বপ্ন পূরণে ভালোভাবে পড়াশোনা করি। ইনশাআল্লাহ খুব শিগগিরই আপনি একটা সুসংবাদ পাবেন। আমরা আমাদের মেধা দেশের জন্য কাজে লাগাতে চাই।’
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আসলাম বলেন, ভ্যান চালিয়ে ছেলেদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন মকিমউদ্দীন, যা দৃষ্টান্ত। উপজেলা প্রশাসন পরিবারের পাশে আছে। তাদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে তাদের সকল সুবিধা দেয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি
বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন বলেন, বিষয়টি আসলেই অনুপ্রাণিত হওয়ার মত । ভ্যান চালিয়ে তিনি দুই ছেলেকে চীনে পড়াশোনা করান। এখান থেকে বুঝা যায় যদি মানুষের ইচ্ছা শক্তি ও পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে তবে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। এটি আমাদের জন্য আনন্দায়ক বিষয়ক। যদি কখনো তার প্রয়োজন হয় সহযোগিতার তবে উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে দাড়াবে।
Leave a Reply