মো: লিটন উজ্জামান (ভেড়ামারা,কুষ্টিয়া) :
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি।”
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর এই দুটি চরণের মাধ্যমেই বোঝা যায় বাঙালীর অস্তিত্বের সাথে কতটা ওতপ্রোতভাবে
মিশে আছে এই ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখটা।এটা বাঙালি জাতির কাছে শুধুমাত্র একটি তারিখ নয়,এটি তাদের জাতীয়তার অন্যতম প্রতীক ‘ভাষা’র স্বাধীনতার অভ্যুদয়ের তারিখ।
মাতৃভাষার গুরুত্ব একটি জাতির হৃদয়ের কতোটা গভীরে অবস্থান করতে পারে সেটার প্রমাণ দিয়েছিলেন বাঙালীরা। বিশ্বের ইতিহাসে একমাত্র জাতি হিসেবে বুকের সজীব রক্তের বিনিময়ে যারা মুখের ভাষার স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন তারা বাঙালি জাতি।
‘বাংলা ভাষা’ – বাঙালী জাতির প্রাণের রসদ বললেও ভুল হবে না। আমরা আজ যে স্বাধীন ভাষায় কথা বলছি,আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করছি সেই ভাষার স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে সুবিশাল এক আত্মত্যাগের অধ্যায়,অপশক্তির বিরূদ্ধে ভীতিহীনভাবে প্রতিবাদের অধ্যায়,সব পিছুটানকে তুচ্ছ করে নিষ্ঠুর বুলেটের সামনে নিজেদের সপে দেওয়ার অধ্যায়,তাজা প্রাণের অবসানের অধ্যায়,জননীর কোল ফাঁকা হওয়া,সধবার সিঁদুর মুছে যাওয়ার অধ্যায়। স্বাধীনতার যাত্রাটা সহজ ছিলো না বাংলার অবরূদ্ধ সন্তানদের কাছে।
আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিলো ১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম কতৃক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশের হাত ধরে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রস্তাব আগ্রাহ্য হলে পূর্ব বাংলায় শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। এরই পরম্পরায় ২৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্রনেতারা ও জনতা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে। ক্রোধে ফেটে পড়ে আপামর জনতা। জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবর্তনস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ছাত্ররা দাড়িয়ে ‘না না’ ধ্বনিতে প্রতিবাদ করে। জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের ভাষণে জিন্নাহ’র কথারই পুনরাবৃত্তি ঘটান। সেদিন ছাত্র-নেতারা আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্দান্ত নেয়। ২০ ফেরুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। ছাত্ররা একযোগে মিছিল বের করার পাক সেনারা নির্মমভাবে তাদের দিকে বুলেট নিক্ষেপ,লাঠিচার্জ
গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। প্রাণ হারায় সালাম,রফিক,জব্বার,বরকতসহ নাম না জানা আরও অনেকে।
বাংলা মায়ের নির্ভীক বীরেরা প্রতিপক্ষের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি।এ ব্রহ্মাণ্ডের মায়া ত্যাগ করতে হতে পারে জেনেও তারা একবারও পিছু হটেননি।পাক সেনাদের নিষ্ঠুর বুলেট একে একে তাদের বক্ষকে বিদ্ধ করলেও তাঁরা তাঁদের বঙ্গজননীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রতিবাদ করে গিয়েছেন,হার মানেননি।জননীর অশ্রুসিক্ত নেত্রের কথা না ভেবে তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছিলেন দেশমাতার মুখের ভাষার মর্যাদার।জীবনের মোহ ত্যাগ করে তাঁরা দেশকে উপহার দিয়েছিলেন চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলা ভাষা।
ছোট্ট ছেলেটির ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ আর্তনাদের ইতি টানেন বাংলার দামাল ছেলেরা,
মাতৃভাষাকে স্বাধীনতার মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে। জাতিসংঘ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ শে ফেব্রুয়ারি কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তারপর থেকেই প্রতিবছর এই দিনটি সারা বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
আজ আমরা যেই মমতাময়ী ভাষায় কথা বলছি,সে ভাষার স্বাধীনতা অর্জনের কারিগরদের প্রতি জানাই আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অগাধ ভালোবাসা। তাঁরা বেঁচে থাকবেন চিরকাল আমাদের স্মৃতির পাতায়,হৃদয়ের অন্তস্থলে ।
Leave a Reply