বার্তা ডেক্স : বাংলাদেশে নির্বাচন সন্নিকটে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপি’র উপর দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে শত শত মামলা দেয়া হয়েছে, যারা আদালতে বারান্দা থেকে বার বার গ্রেফতার হচ্ছেন। শুক্রবার (১০ নভেম্বর) ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে।
গার্ডিয়ান বলছে, বাংলাদেশের কারাগারে এখন ধারণক্ষমতার কয়েকগুন বেশি বন্দী। গেলো কয়েক মাস ধরে বিরোধীদের উপর গ্রেফতার-হয়রানি চললেও, ২৮ অক্টোবর শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে ঢাকায় বিএনপি ’র ডাকা মহাসমাবেশের পর সরকারি দমন-পীড়ন আরও বেড়েছে । গত দুই সপ্তাহে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর প্রায় ১০,০০০ বিরোধী নেতা, সমর্থক ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী আগে থেকেই কারাগারে বন্দী। অনেকের বিরুদ্ধে শত শত ফৌজদারি অভিযোগ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা প্রায় চার হাজার। অথচ সেখানে এখন ১৩ হাজার ৬’শর বেশি বন্দী।
বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে যে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবেনা। বিএনপি বলেছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে সরে না যাওয়া পর্যন্ত তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না।
২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের আগের দিনগুলোতে বিএনপির শতাধিক নেতাকে আটক করা হয়। সেদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুলিশের সাথে, লাঠি, লোহার রড, ছুরি এবং অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সমাবেশে হামলা করতে দেখা যায়। সহিংসতায় একজন বিএনপি কর্মী, একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও একজন সাংবাদিকসহ তিনজন নিহত হয়েছেন।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজের ভাষায়, ‘বিএনপিকে দমন করার জন্য কর্তৃপক্ষকে পূর্বপরিকল্পিত সহিংসতায় অংশ নিতে দেখা গেছে।
তিনি বলেন, সেদিন পুলিশের প্রতিক্রিয়া সহিংসতার সূত্রপাত ঘটায়। ধারণা করা হচ্ছে, সমাবেশের আগে পরিকল্পিতভাবে ইন্টারনেট পরিষেবাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিলো, যা শুধুমাত্র কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ বিঘ্নিত করার জন্যই নয়, পুলিশের কর্মকাণ্ডের সরাসরি সম্প্রচার রোধ করার জন্যও।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রবার্ট এফ কেনেডি’র অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড লিটিগেশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট অ্যাঞ্জেলিটা বেয়েনস বলেন, ‘গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে বিরোধী নেতা-কর্মী এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতারের সংখ্যা ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন কতোটা চরম তার একটি ভালো সূচক নির্দেশ করে।’
গ্রেফতার হওয়া কয়েক হাজারের মধ্যে বিএনপির অন্যতম সিনিয়র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রয়েছেন। ২৯ অক্টোবর আটক হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলার সময় মিথ্যা অভিযোগে তাকে তুলে নেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সেসময় তিনি বলেন, ‘আমরা অসংখ্য ঘটনা দেখেছি যেখানে আমাদের কর্মীদের সাজানো-মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং পুলিশ ও বিচার বিভাগ আমাদের মুখ বন্ধ করতে আওয়ামী লীগের সাথে একসাথে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।’ ১শ’র বেশি মামলা মাথায় নিয়ে মির্জ ফখরুল বলেছিলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে সরকারের লক্ষ্য আমাদের সকল নেতাকে কারাগারে বন্দী করা এবং একতরফা নির্বাচন করা।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ৫০ লাখের বেশি নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে ১৩৮ হাজারেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কাজ করা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্টের মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘বিরোধীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। যার মধ্যে আছে- গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পঙ্গুত্ব, নির্যাতনের মতো ঘটনা। বাংলাদেশে যখনই নির্বাচন হয় তখনই বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে ভুয়া ফৌজদারি মামলায় বিরোধী কর্মীদের নির্যাতন এবং নির্বিচারে আটক করা হয়।’
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিরোধীদের হয়রানি করা হয়েছিলো। পরবর্তিতে নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এই মুহূর্তে অধিকাংশের অনুমান, একই দৃশ্য আসন্ন নির্বাচনেও দেখা যাবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শেখ হাসিনাকে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে। গেলো সপ্তাহে ব্রিটিশ হাইকমিশনার ‘সহিংসতা পরিহার এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’র লক্ষ্যে বিএনপি নেতাদের সাথে দেখা করেন। মার্কিন সরকার সম্প্রতি ‘নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য" অজ্ঞাতনামা সরকারি কর্মকর্তাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং গত মাসে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনাকে বিএনপির সাথে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভণ্ডামির অভিযোগ তুলে পাল্টা প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাইডেন কি ট্রাম্পের সাথে সংলাপ করছেন? যেদিন তাদের সংলাপ হবে, আমিও বিরোধীদের সঙ্গে সংলাপ করবো।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকার এখন বিচার বিভাগ ও পুলিশকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের প্রস্তুতি নিয়েছে। গেলো সপ্তাহে প্রকাশিত একটি ভিডিও ক্লিপে একদল সশস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মীদের সাথে টহলরত পুলিশ অফিসারদের বলতে শোনা যায়, ‘এক একটা করে বিএনপি ধরো আর মারো।’
এদিকে, বিএনপি নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে দাবি করছে সরকার ও পুলিশ। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘এই ফৌজদারি মামলাগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজী হননি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, ‘তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরই মামলা করেছেন। এছাড়া ২৮ অক্টোবর পুলিশ কর্মকর্তাদের হত্যা ও আহত করার জন্য দায়ীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোবাশ্বর হাসান বলেছেন, শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক পদ্ধতিগুলি বিএনপির আন্দোলনের গতি বাড়িয়েছে। তাছাড়া হাসিনা সরকারের দুর্বল অর্থনীতি এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। যার প্রেক্ষিতে ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি শ্রমিক ও দরিদ্র শ্রমিকরাও দলে দলে অংশ নেয়। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ গোলাম কিবরিয়া / ই-মেইল :daliysomoyaralo24info@gamil.com --(জাতীয় দৈনিক সময়ের আলো প্রিন্ট পত্রিকার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই)
দৈনিক সময়ের আলো ২৪ডট কম