ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ প্রথম পর্ব
নিজস্ব প্রতিনিধি : রাজধানীর উপকণ্ঠ গাজীপুর। অর্থনীতি ও রাজনীতিতে রয়েছে এখানকার আলাদা গুরুত্ব। বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে এই শহরের রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি জাতীয়ভাবে আলোচনায় এসেছেন। তবে পদ পদবীর বাইরে থেকেও গাজীপুর শহরের রাজনীতি ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন একজন। নাম তার কামরুজ্জামান কামরুল। স্থানীয়দের কাছে মাউচ্ছা কামরুল বা কোম্পানি কামরুল নামে পরিচিতি তার। সব সময় লুঙ্গি পরিধান করেন, মেঝেতে বসে খাওয়া-দাওয়া করেন। সব মিলিয়ে চালচলন, বেশভূষায় নিজেকে বানিয়ে রেখেছেন ‘রহস্যময়’।
তবে এসবের আড়ালে তিনি গাজীপুরে দখলের রাজত্ব কায়েম করেছেন। সরকারি খাসজমি, বিল, খাল এমনকি সাধারণ মানুষের জমিও ইচ্ছামতো নিজের করে নেন। জাল দলিল তৈরি করতে রেখেছেন কর্মচারী। হাজার হাজার বিঘা জমি দখল করে অঘোষিত সম্রাট বনে গেলেও পুলিশের কাছে তার বিরুদ্ধে এতোদিন অভিযোগ দায়েরের সাহস পায়নি কেউ। কারণ দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বলয়ে গড়ে তুলেছেন দখলের দরবার। যারা বিভিন্ন সময়ে মুখ খুলতে চেয়েছিলেন, তারা কেউ এলাকাছাড়া হয়েছেন। আবার কেউ কেউ অদৃশ্য এক কারণে বন্ধ করে দিয়েছেন মুখ।
দীর্ঘ এক সপ্তাহ সরেজমিন ঘুরে গাজীপুরের সাধারণ মানুষ এবং নানা মতের রাজনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে কামরুজ্জামান কামরুল সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। একসময় পেটের তাগিদে স্থানীয় বাজারে মাছ বিক্রি করতেন। অর্থাভাবে পড়াশোনাও করতে পারেননি। চরম দারিদ্র্যের কারণে ঠিকঠাক চিকিৎসাও করাতে পারেননি অসুস্থ বাবা-মায়ের। এর পরই অসাধু পথে ভাগ্য বদলাতে শুরু করেন কামরুল। সময়ের ব্যবধানে এখন তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। খাল-বিল সরকারি খাসজমিসহ ব্যক্তিমালিকানার হাজার হাজার বিঘা জমি দখল করে বানিয়েছেন শিল্পকারখানা, একাধিক হাউজিং প্রকল্প। অন্যের জমি বিভিন্ন শিল্পকারখানার কাছে ভাড়াও দিয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতিক থেকে শুরু করে সরকারি কর্মচারী কিংবা ব্যবসায়ীদের অনেকেই নিয়মিত হাজিরা দিতেন তার দরবারে। রাত গভীর হলে প্রভাবশালীদের ভিড় ছিলো কামরুলের বাড়িতে। তার নির্দেশে হত্যা মামলায় আসামির নাম বদলে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। ভয়ে এলাকার মানুষ , মুখ খুললেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। তার বিরুদ্ধে আছে সাংবাদিককে মারধর করার অভিযোগও। অদৃশ্য ক্ষমতার বলয়ে থাকায় কামরুলের বিরুদ্ধে কেউ সাহস করে কথা বলেন না।
সাধারণ মানুষের বেশে কামরুলের বাড়ির সামনে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গেটে দারোয়ানের সতর্ক পাহারা। আশপাশের আধা কিলোমিটার পর্যন্ত লাগিয়ে রেখেছেন সিসি ক্যামেরা। সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হয় আশপাশে চলাচলকারী লোকজনের গতিবিধি। সন্দেহজনক মনে হলেই নেওয়া হয় ব্যবস্থা।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা বলছেন, কামরুলের অবৈধ সাম্রাজ্যের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি দেখাশোনা করেন মমতাজ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। এ ছাড়া কামরুলের এসব কাজে জড়িত রয়েছেন তার ভাই আমির হোসেন ও বড় ছেলে হাসিবুল রনি।
এলাকাবাসীর তথ্যমতে, মাছ বিক্রির পাশাপাশি টঙ্গীর এক ব্যবসায়ীর বাসায় গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ করতেন কামরুল। ওই ব্যবসায়ী জমি কেনাবেচার কাজ করতেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেও টুকটাক জমির দালালি শুরু করেন। ওই সময় আইয়ুব খান নামের আরও একজন চিহ্নিত ভূমিদস্যু ছিলেন। কামরুল ব্যবসা করলেও তাকে কমিশন দিতে হতো। এর জেরে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। এরপর ২০০৪ সালে টঙ্গীর শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রিন্সকে দিয়ে গুলি করিয়ে হত্যা করা হয় আইয়ুব খানকে। প্রিন্স পরে ২০০৯ সালের দিকে র্যাব সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। তবে আইয়ুব খান হত্যা মামলায় আসামি করা হয় কামরুলকে। এ ছাড়া কামরুলের কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে এই মামলায় আসামি করা হলেও অদৃশ্য কারণে বেঁচে যান সবাই। এই আইয়ুব খান ছিলেন গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি হাসান উদ্দিন সরকারের ঘনিষ্ঠ।
আইয়ুব খানকে হত্যার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কামরুলকে। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে সেই কামরুল এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। সাতাইশ সড়ক সংলগ্ন ৬ বিঘা জমিতে তার মার্কেট, সঙ্গে আলিশান বাড়ি-অফিস। সেখানে তিনি এখন নির্মাণ করছেন ১০ তলা আবাসিক ভবন। এই বাড়িটিও আলমগীর কবির নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে দখল করা। এ নিয়ে গাজীপুরের আদালতে দেওয়ানি মামলাও করেছেন ওই ভুক্তভোগী। এ ছাড়া কামরুলের রয়েছে বিএমডব্লিও, লাক্সেস, ডিসকভার ইত্যাদি নামি-দামি ব্র্যান্ডের ১০-১২টি গাড়ি।
স্থানীয়রা বলেন, টঙ্গীর সাতাইশ ও গুটিয়া এলাকা ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেকেই জমি ফেলে ভারতে চলে যান। পরবর্তী সময়ে সেই জমি তাদের আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয়রা ভোগদখল করতেন। গত কয়েক বছরে জাল দলিল তৈরি করে কামরুল সেসব জমির অধিকাংশই দখল করে নিয়েছেন। জাল দলিল তৈরির লোক রেখেছেন। তারা কামরুলের নির্দেশে জাল-ভুয়া দলিল তৈরি করেন। আবার কোথাও কোথাও অল্প জমি কিনে আশপাশের খালি জমি বালু ফেলে জোরপূর্বক ভরাট করে ফেলেছেন। কখনো তিনি সহযোগীদের ভুয়া মালিক সাজিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করে নেন। এভাবেই সাতাইশ ও গুটিয়া মৌজার হাজার বিঘা জমি এখন তার দখলে।
সরেজমিন দেখা যায়, হযরত শাহজালাল রোড থেকে গুটিয়া ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় সব জমিই তার দখলে। এসব জমি দখল করে তিনি বানিয়েছেন শিল্পকারখানা। অনেকগুলো কারখানার কাছে ভাড়া দিয়েছেন। বানিয়েছেন ছায়াকুঞ্জ ও মায়ের দোয়া রিয়েল এস্টেট নামে দুটি আবাসন প্রকল্প। এসব আবাসন প্রকল্পের প্রায় সব জমি প্রভাব খাটিয়ে দখল করা। কোনোটি দখল করেছেন ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে আবার কোনোটি ভোগদখলকারীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে। সরকারি খাসজমিও রয়েছে এসব আবাসন প্রকল্পে।
সাতাইশ এলাকার এক নারী বলেন, ‘এইহানে আমাগো আত্মীয়দের জমি ছিল। তাগো সব জমি দখল করে নিয়া গেছে। তারা এহন এই এলাকায় নাই। অন্য জায়গায় ভাড়ায় থাকে। আমাগো জমিও দখল করতে চাইছে। বারবার জমি বিক্রির জন্য চাপ দিতাছে। আমরা এহানে বাড়ি বানাব। কিন্তু কোনো মালপত্র কামরুলের লোকজন ভেতরে আনতে দেয় না। কোম্পানির (কামরুল) বিরুদ্ধে কারও কোনো কথা বলার সাহস নাই। কেউ কিছু বললেই তাকে মারধর করে।’
বিলীন হচ্ছে সরকারি জলাশয়-বিল: কামরুল এরই মধ্যে তার ছায়াকুঞ্জ আবাসন প্রকল্পের নামে সাতাইশ মৌজার ২৬ বিঘা আয়তনের ধনাই বিল ভরাট করে ফেলেছেন। বর্তমানে পাশের দাঁড়াইল মৌজার বাগুনি বিলও একই প্রকল্পের নামে দেদার ভরাট চলছে। এই বিল দুটি সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জলাশয়। সেইসঙ্গে সরকারের ‘ডিটেইলস এরিয়া প্ল্যান’ (ড্যাব) চিহ্নিত সংরক্ষিত জলাশয়। নিয়মানুযায়ী এসব জলাশয় ভরাট করার অনুমতি কারও নেই। এ ঘটনায় এলাকার ভূমিহীন মৎস্যজীবীরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করলেও ভরাট থামেনি।
এলাকাবাসী জানান, ভূমিহীন মৎস্যজীবীরা ধনাই বিল ও বাগুনি বিলে মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এলাকার একজন চিহ্নিত ভূমিদস্যু ‘ছায়াকুঞ্জ আবাসন প্রকল্প-৬’ নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে রাতারাতি ধনাই বিল ভরাট করে ফেলে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনে অভিযোগ জানানো পরও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ছায়াকুঞ্জ আবাসন প্রকল্পের নামে বিলটি দখল করার পর সেখানে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য বিশাল আকারের শেড নির্মাণ করা হয়েছে। ভরাট সম্পন্ন হওয়ার পর ধনাই বিলে ছায়াকুঞ্জের এসব সাইনবোর্ড পাশের বেগুনি বিলেও স্থানান্তর করে সেই বিলও ভরাট করে ফেলা হয়।
অসহায় পরিবেশ অধিদপ্তর: খাস খতিয়ানভুক্ত দুটি বিল, একটি খাল, একাধিক পুকুর ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্পের ৫১ বিঘাসহ প্রায় ৪০০ একর সরকারি জমি দখলের অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়ের করা এক মামলায় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে কারাগারে পাঠানো হয় কামরুজ্জামান কামরুলকে। সিআর মামলা নং-৩৯০/২০১৮। ছায়াকুঞ্জ-০৫ এবং ছায়াকুঞ্জ-০৬ আবাসিক প্রকল্পের নামে এই জলাশয় ও খাস জমি ভরাট করা হয়। এরপর জামিনে বের হয়ে তিনি হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশ দেন আদালত। আর এই সুযোগে ওইসব জমিতে আবাসন প্রকল্পে গড়ে তোলেন কামরুল ইসলাম।
ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বাদী হয়ে টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। সে মামলায় কামরুলের নাম দিতে চাইলেও রহস্যজনক কারণে পুলিশ মামলা নেয়নি। এমনই দাবি করেছিলেন মামলার বাদী।
এই মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে কয়েকদিন ধরে কল্পনা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এজাহারে কামরুলের নাম দিতে চাইলেও ওসি তা দিতে দেননি। অন্যদিকে মামলার এজাহারে ম্যানেজার হানিফের নাম উল্লেখ করা হলেও বাবার নাম ও ঠিকানা অজ্ঞাত রাখা হয়েছে।
কল্পনা বলেন, এজাহারে কামরুলের নাম দিতে চাইলে ওসি বলেছেন, মামলা অন্যদিকে চলে যাবে। কোনদিকে যাবে সেটা তো আমি জানি না। স্পষ্টভাবে কয়েকবার নাম বলছি। বর্তমানে কামরুলের এই ম্যানেজার জামিনে বের হয়েছেন। এই হানিফ কামরুলের ঘনিষ্ঠ। হানিফই কামরুলের সাম্রাজ্যের অঘোষিত ম্যানেজার। পরবর্তী সময়ে হানিফকে বাঁচাতে হালিম নামে একজন অদৃশ্য ব্যক্তিতে তৈরি করে তাকে ম্যানেজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর হালিমকে দেখানো হয়েছে, সে হত্যাকাণ্ডের পর আত্মগোপনে রয়েছেন। বাস্তবে হালিম নামে কারও অস্তিত্ব নেই।
মামলাটি তদন্ত করছে গাজীপুর শিল্প পুলিশ। জানতে চাইলে গাজীপুর শিল্প পুলিশের প্রধান পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, ‘মামলাটি তদন্তনাধীন।’
তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা যাবে না। তবে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে এবং আমাদের একটা তদারকি টিমও আছে। খুব শিগগির আমরা হয়তো তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেব। আপনারা জানতে পারবেন।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মো. কামরুজ্জামান কামরুলকে একাধিক বার ফোন দিলেও ফোন রিসিভ করেনি ।
Leave a Reply