বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন
মোঃ মিন্টু শেখ : ১৯৭১ সালের এই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক এ ভাষণ পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্রে রূপ নেয়।
এ দিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। এ ছাড়া এ ভাষণটি পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এর পরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণ। এ স্বল্পসময়ে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। তিনি তাঁর ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত। আমি বলে দিতে চাই- আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দুটি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিকনির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
যেভাবে তৈরি হয় প্রেক্ষাপট : ৬ মার্চ বিকাল ৫টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন এমন বার্তা ঘোষণা করা হয় পাকিস্তান রেডিও থেকে আগের দিন ৫ মার্চ। স্বভাবতই গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি তখন ভাষণের দিকে। বঙ্গবন্ধু ওইদিন তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন। ৫ মার্চ ঢাকাস্থ পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুবের ফোন আসে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ফোন রিসিভ করলে ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘শেখ সাহেবের সঙ্গে মাননীয় প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন।’ এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু গিয়ে রিসিভার কানে তুলে বলতে থাকেন ‘কিছু শুনতে পাচ্ছি না, কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’
পরক্ষণে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ শুনে পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি অবহিতপূর্বক তদন্ত কমিশন গঠন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের কথা বলেন। ৬ মার্চ বিকালে প্রেসিডেন্টের ভাষণ শোনার জন্য বঙ্গবন্ধু একটি ট্রানজিস্টর নিয়ে তাঁর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। তার আগে জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনাকে বলেন, আমি প্রেসিডেন্টের ভাষণটি নীরবে শুনতে চাই।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান অভিমুখে একটা ট্রাকে রওনা হন। ওই ট্রাকে ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ। পেছনের আরেকটি ট্রাকে ছিলেন আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, মোস্তফা মোহসীন মন্টু, কামরুল আলম খান খসরু ও মহিউদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছার আগেই সেখানে হাজির হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, শেখ জেলি (শেখ হাসিনার খালাতো বোন) এবং এ টি এম সৈয়দ হোসেনের বড় মেয়ে শেলি। সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে বিশালাকৃতির নৌকাশোভিত সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান শিশু পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচারিত হবে রেডিওতে বারবার এমন ঘোষণা হচ্ছিল। শেখ হাসিনা যে কারণে একটি রেডিও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে রেডিও নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান থেকে বাড়ি ফেরেন। রাত ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপাঠক ইকবাল বাহার চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তান রেডিও ঢাকাস্থ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
তাঁরা জানান, সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের নির্দেশে তাঁরা ভাষণ সম্প্রচার করতে পারেননি। ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করার কথা বলেন তাঁরা। ফলে সব অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ৮ মার্চ সকাল ৮টায় হঠাৎ পাকিস্তান রেডিও ঘোষণা করে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ৯টায় প্রচার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু রাতে সহধর্মিণী ফজিলাতুন নেছা মুজিব, ছেলেমেয়ে শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা, শেখ রাসেলের উপস্থিতিতে বলেন, ‘আমার যা বলার তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোনো মুহূর্তে হয় গ্রেফতার নয়তো হত্যা করবে। আজ থেকে প্রতিদিন আমার সঙ্গে খাব।’
২৪ মার্চ পর্যন্ত সবাই একসঙ্গে খেয়েছেন। কিন্তু ২৫ মার্চ ব্যতিক্রম ঘটে। বঙ্গবন্ধু রাত ১১টা পর্যন্ত বাড়ির নিচতলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত সময় পার করেন। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। কার্যত পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ গোলাম কিবরিয়া / ই-মেইল :daliysomoyaralo24info@gamil.com --(জাতীয় দৈনিক সময়ের আলো প্রিন্ট পত্রিকার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই)
দৈনিক সময়ের আলো ২৪ডট কম