লেখক, মোঃ মোস্তফা কামাল তোহা : অবিশ্বাস্য গতিতে বিশ্বব্যাপী ধেয়ে আসছে অর্থনৈতিক মন্দা। এর শুরুটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হলেও, চূড়ান্ত রূপ পেতে চলেছে তা ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে। ২৬ অক্টোবর রাতে ২০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ১৪০টা যুদ্ধ বিমান দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ইরানে হামলা চালিয়েছে দখলদার ইসরাইল, এতে মাটি কামড়িয়ে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ১৯৪৭-৪৮ সালে জন্ম লাভ করা ইসরাইল তার অস্তিত্ব সঙ্কটে এরইমধ্যে আগ্রাসন চালিয়ে দখলে নিয়েছে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের বিশাল অংশ। আর এমনটা সম্ভব হয়েছে পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদদ ও সামরিক হস্তক্ষেপে। এরচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ফিলিস্তিনের দুই প্রতিবেশী দেশ ইসরাইলের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া। নিকটতম এই দুই আরব প্রতিবেশী হলো মিশর ও জর্ডান। যে দেশ দু’টি ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও দখলদার রাষ্ট্রকে মিশর ও জর্ডানের এমন স্বীকৃতি প্রদানের পরেও গোটা মুসলিম বিশ্ব তা নীরবে হজম করে। কোন প্রকার কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি আরব বিশ্ব কিংবা ওআইসি। আর তখন থেকেই তথাকথিত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে হেলছে-দুলছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মানদণ্ড। এর পেছনে রয়েছে মুসলিম দেশগুলোর মুনাফেক নেতৃবৃন্দের বিষাক্ত থাবা। ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই থেকে শুরু করে ১৭০০ শতাব্দীর মীর জাফর-মীর সাদিক। যাদের মুনাফেকি আচরণের খেসারত দেয় সুবিশাল সাম্রাজ্য ও জাতি-গোষ্ঠী। এখনো ইরান, ইরাক, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনসহ আরব বিশ্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে মুনাফিকদের বিষ বোতল। মুনাফেকদের ঘটনা লগ্নে চিহ্নিত করা না গেলেও, একটা পর্যায় এসে তাঁদের ভাগ্যাকাশে নেমে আসে এক করুণ পরিণতির বাস্তবতা। সেটাই ঈমানদারদের আসল বিজয়।
বিশ্ব মুসলিম এখন নিজ ঘরে দু’ভাগে বিভক্ত। ঈমানদার ও মুনাফেক। তথা হক-বাতিল। আর এই বিভক্তির অবসানের দায়িত্ব ক্বাবার মালিকের। আসছি ইরানের ওপর শনিবার রাতের হামলার বিষয়ে। বিশ্বের ১৪৫টি সামরিক শক্তিধর দেশের মধ্যে ১৪তম অবস্থানে থাকা ইরান যদি এখন পাল্টা হামলা চালায়, তবে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ ভাবে এ যুদ্ধে জড়াবে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশই। এতে বিশ্ব বাণিজ্য বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় বাড়বে আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম। জ্বালানি খাত পড়বে চ্যালেঞ্জের মুখে। কমবে বিভিন্ন প্রকার গাড়ীর মূল্য। শুধু তাই নয়, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে আক্রান্ত হবে পুরো মধ্যপ্রাচ্য। আর এসময়ে ঘটতে পারে যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বা পৃথক যে কোন অঞ্চলের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ। জন্ম নিতে পারে আলাদা আলাদা রাষ্ট্রের। এমন পরিস্থিতিতে ঝুঁকি বাড়বে পরমাণু হামলার। যে হামলার রেশ শতাব্দীর পর শতাব্দী বয়ে বেড়াবে হতভাগা বিশ্ব।
ফিরে আসছি ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ প্রসঙ্গে, প্রশ্ন হলো এ যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হলে বাংলাদেশ থাকবে কোন পক্ষে? এর আগে বলে রাখা ভাল, বর্তমান বিশ্ব পরাশক্তি দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে মার্কিন ও ন্যাটোভুক্ত ৩১টি দেশ। অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়া। আসছি প্রশ্নের উত্তরে, বাংলাদেশ তার বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরাসরি কোনো দেশে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে নিজস্ব সৈন্যবাহিনী দিয়ে আক্রমণে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে বিভিন্ন রসদ সরবরাহ করতে পারে তুরস্ক-আলবেনিয়া যে পরাশক্তির পক্ষ নেবে তাঁদের পক্ষে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বাংলাদেশের ওপর আসতে পারে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা।
সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে উপমহাদেশের যেকোনো একটি দেশ আক্রান্ত হলে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নেমে আসতে পারে ধর্মীয় সংঘাত। এমন সব সমীকরণ সামনে রেখে গুরুত্ব দিতে হবে দেশের জিডিপিতে ১৪.১০ শতাংশ অবদান রাখা কৃষি খাতে। এতে বৃদ্ধি পাবে খাদ্য উৎপাদন। জোর দিতে হবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায়। মজুত রাখতে হবে কমপক্ষে তিন বছরের চাল-ডালসহ নিত্যবাজারের পণ্য। এছাড়াও ইরান-ইসরাইল যুদ্ধকালীন সবার চেষ্টা থাকবে নিজ নিজ ঘরে শুকনো খাবার ও এ জাতীয় খাদ্য পণ্য মজুতের। এতে দেখা দিতে পারে খাদ্য সঙ্কট। শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটবে মানুষ। জনজীবনে নেমে আসতে পারে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার কালো মেঘ।
অপ্রত্যাশিত এমন কঠিন থেকে কঠিনতর সময়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের নিম্ন আয়ের অন্যান্য দেশগুলোতেও দেখা দিতে পারে অবর্ণনীয় ও নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষ। ইন্টারনেট থেকে পাওয়া এক পরিসংখ্যান তুলে ধরছি- “জাতিসঙ্ঘের হিসাব মতে, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে গাজায় ৯৬ শতাংশ নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষি উৎপাদন কমেছে ৯৩ শতাংশ, সামগ্রিক উৎপাদন কমেছে ৯২ শতাংশ এবং সেবা খাতের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ৭৬ শতাংশ। বেকারত্বের হার বেড়ে ৮১ দশমিক ৭ শতাংশে (বর্তমানে প্রায় ৮৫ শতাংশে) পৌঁছেছে, যা এই অঞ্চলের মানবিক বিপর্যয়কে আরো প্রকট করেছে”। এ তথ্য-উপাত্ত থেকেও সামনের পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তা বুঝা মুশকিল।
ইরানে বিশ্ব মোড়লদের মদদে ইসরাইলের এমন হামলা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহরত হিসেবেই দেখা যেতে পারে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মোতায়েন করেছে অত্যাধুনিক এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান। প্রসঙ্গত, গত ১ অক্টোবরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে শনিবার রাতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এ হামলায় দুই ইরানি সেনা নিহত হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে ইরানের সেনাবাহিনী। ইরানে এমন ভয়াবহ হামলার পরে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইসরাইলি বর্বরতার নিন্দা জানালেও উল্টো ইসরাইলে হামলা না চালাতে ইরানকে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব রাজনীতির এমন পক্ষপাতদুষ্ট অধঃপতন ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও ঘটেছিল। ইতিহাস তা ই সাক্ষী দেয়।
Leave a Reply